রুই মাছের রক্ত সংবহনতন্ত্র (Blood circulatory system of Labeo rohita)
প্রাণিদেহের যেসব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পারস্পরিক সহযোগিতায় রক্ত, খাদ্যসার, হরমোন, রেচন বর্জ্য ইত্যাদি দ্রব্য দেহের বিভিন্ন কোষে পরিবাহিত হয় তাকে রক্ত সংবহনতন্ত্র বলে। রক্ত, হৃদপিণ্ড, ধমনিতন্ত্র, শিরাতন্ত্রের সমন্বয়ে Labeo-র রক্ত সংবহনতন্ত্র গঠিত।
১। রক্ত (Blood)
রক্তরস (plasma) ও রক্ত কণিকা (blood corpuscles) নিয়ে রুই মাছের রক্ত গঠিত। রক্ত কণিকা দু ধরনের যথা- ডিম্বাকৃতির নিউক্লিয়াসযুক্ত লোহিত রক্ত কণিকা (RBC) এবং অ্যামিবয়েড লিউকোসাইডযুক্ত শ্বেত রক্ত কণিকা (WBC)। রুই মাছের রক্ত লাল বর্ণের।
২। হৃদপিণ্ড- (Heart)
রুই মাছের হৃদপিণ্ড ফুলকাদ্বয়ের পিছনে পেরিকার্ডিয়াল গহ্বর (Pericardial cavity) নামক একটি বিশেষ প্রোকোষ্ঠে আবৃত থাকে। পেরিকার্ডিয়াম নামক শক্ত আবরণে হৃদপিণ্ডটি আবৃত থাকে।
রুই মাছের হৃদপিণ্ড তিনটি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। যথা-
- সাইনাস ভেনোসাস (sinus venosus)
- অ্যাট্রিয়াম বা অলিন্দ (atrium or auricle) এবং
- ভেন্ট্রিকল বা নিলয় (ventricle)।
সাইনাস ভেনোসাস পাতলা প্রাচীর বিশিষ্ট প্রকোষ্ঠ যা হৃদপিণ্ডের পৃষ্ঠদেশে অবস্থিত। শিরাসমূহের CO2 অ্যাট্রিয়াম হৃদপিণ্ডের বৃহত্তম প্রকোষ্ঠ। এর প্রাচীরও পাতলা। এটি একদিকে সাইনাস ভেনোসাস অন্যদিকে অ্যাট্রিও ভেন্ট্রিকুলার ছিদ্রপথে ভেন্ট্রিকলে উন্মুক্ত।
পেরিকার্ডিয়াম গহ্বরে অঙ্কীয় পশ্চাৎ দেশে ভেন্ট্রিকল অবস্থিত। এর প্রাচীর পুরু ও মাংসল। এর গহ্বর নিয়ত এবং একটি ছিদ্রপথে বাল্বাস আর্টারিওসাস নামক প্রকোষ্ঠে যুক্ত হয়। এ ছিদ্রে দুটি অর্ধ চন্দ্রাকৃতি কপাটিকা থাকে। ফলে এদের হৃদপিণ্ডের মধ্য দিয়ে রক্ত কেবল একমুখী প্রবাহে প্রবাহিত হয়।
৩। ধমনিতন্ত্র (Arterial system)
যেসব রক্ত বাহিকার মাধ্যমে O2 যুক্ত রক্ত সারা দেহে প্রবাহিত হয় তাকে ধমনিতন্ত্র বলে।
রুই মাছের ধমনিতন্ত্র প্রধানত-
অন্তর্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল- ধমনি (afferent branchial arteries), বহির্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি (efferent branchial arteries), ডর্সাল অ্যাওর্টা ও এর শাখা প্রশাখা নিয়ে গঠিত।
(ক) অন্তর্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি (Afferent branchial artery)
যে সব ধমনি হৃদপিণ্ড হতে ফুলকার দিকে CO2 সমৃদ্ধ রক্ত বহন করে তাকে অন্তর্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি বলে। হৃদপিণ্ডের বাল্বাস অ্যাওটার সম্মুখ ভাগ থেকে যে দৃঢ় প্রাচীর বিশিষ্ট ধমনি উৎপন্ন হয় তাকে ভেন্ট্রাল অ্যাওর্টা বলে।
এটি গলবিলের অঙ্কীয় দিক দিয়ে হাইওয়েড আর্চ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ভেন্ট্রাল অ্যাওটার প্রতিপাশ থেকে চারটি করে মোট চার জোড়া অন্তর্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি বের হয়। প্রথম জোড়া ধমনি প্রথম ফুলকা জোড়ায় প্রবেশ করে। অনুরূপভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ জোড়া ধমনি যথাক্রমে ২য়, ৩য় ও ৪র্থ ফুলকা জোড়ায় প্রবেশ করে। এরা CO2 সমৃদ্ধ রক্ত ফুলকায় সরবরাহ করে।
(খ) বহির্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি (Efferent branchial artery)
যেসব ধমনি ফুলকা হতে O2 সমৃদ্ধ রক্ত দেহের বিভিন্ন অংশে পরিবহন করে তাকে বহির্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি বলে। রুই মাছের চারজোড়া ফুলকা থেকে চার জোড়া বহির্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনির সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ প্রতিটি ফুলকা আর্চে একটি করে অন্তর্বাহী ও বর্হিবাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি থাকে।
প্রথম বহির্বাহী ধমনি অঙ্কীয়দেশে হাইওয়েড আর্চের সিউডোব্রাঙ্কে রক্ত বহন করে এবং সিউডোব্রাঙ্কের সম্মুখে অপথ্যালমিক ধমনি বিস্তৃত হয় ও চোখে রক্ত প্রেরণ করে। প্রতি পাশের প্র ম ও দ্বিতীয় বহির্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি মিলিত হয়ে একটি অনুদৈর্ঘ্য ল্যাটারাল অ্যাওর্টায় পরিণত হয়। তৃতীয় ও চর্তু বহির্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি একত্রিত হয়ে ল্যাটারাল অ্যাওর্টায় পরিণত হয়। ল্যাটারাল অ্যাওর্টা সম্মুখে ক্যারোটিড ধমনিরূপে বিস্তৃত হয় এবং করোটিতে রক্ত সরবরাহ করে। দু’পাশের ল্যাটারাল অ্যাওর্টা পশ্চাতে একীভূত হয়ে ডর্সাল অ্যাওর্টা গঠন করে।
(গ) ডর্সাল অ্যাওর্টা (Dorsal aorta)
ডর্সাল অ্যাওর্টা দেহের পৃষ্টদেশে মেরুদণ্ডের নিচ দিয়ে সম্মুখ হতে পশ্চাৎ পর্যন্ত অর্থাৎ লেজ পর্যন্ত প্রসারিত থাকে। ইহা বিভিন্ন শাখা ধমনি সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত সরবরাহ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শাখা ধমনি হচ্ছে সিলিয়াক ও মেসেনটারিক ধমনি, সাবক্ল্যাভিয়ান ধমনি, প্যারাইটাল ধমনি, রেনাল ধমনি, কডাল ধমনি।
৪। শিরাতন্ত্র (Venous system)
যে সকল রক্তনালিকা সাধারণত দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে CO2 সমৃদ্ধ রক্ত হৃদপিণ্ডে নিয়ে আসে তাকে শিরা বলে। শরীরের সম্মুখ অংশের অ্যান্টেরিয়র কার্ডিনাল শিরা চুক্ষগোলক, নাসা ও হাইওয়েড অঞ্চল থেকে রক্ত সংগ্রহ করে এবং ইনফিরিয়র জুগুলার শিরা নি¤ড়বচোয়ালের পার্শ্বদেশ এবং ফুলকা থলিসমূহের অঙ্কীয়দেশ হতে রক্ত সংগ্রহ করে ডাক্টাস ক্যুভিয়ে উন্মুক্ত হয় এবং ডাক্টাস ক্যুভিয়ে হৃদপিণ্ডের সাইনাস ভেনোসাসে মুক্ত হয়।
সাবক্লেভিয়ান শিরা দেহের দুই পাশের বক্ষ পাখনা হতে রক্ত সংগ্রহ করে সরাসরি সাইনাস ভেনোসাসে মুক্ত হয়। দেহের পশ্চাৎ অংশ ও পৌষ্টিকতন্ত্রের বিভিন্ন অংশ থেকে সৃষ্ট বিভিন্ন শিরা সম্মিলিত ভাবে হেপাটিক পোর্টাল শিরা গঠন করে যার মাধ্যমে রক্ত যকৃতে যায় এবং যকৃতে প্রবেশ করে শাখায়িত হয়ে রক্ত জালকের সৃষ্টি করে। লেজ হতে মধ্য পুচ্ছক শিরা (cardinal vein) রক্ত সংগ্রহ করে। এটি দেহকা- অঞ্চলে ডান ও বাম অংশে দ্বিধাবিভক্ত হয়। ডান শাখাটি ডান পশ্চাৎ কার্ডিনাল শিরা নামে সামনের দিকে অগ্রসর হয় এবং বাম শাখাটি রেনাল পোর্টাল শিরা হিসেবে বৃক্কে (kidney) প্রবেশ করে এবং কৌশিক জালিকার সৃষ্টি করে।
0 Comments